টুঙ্গীপড়ার খোকা থেকে বাংঙ্গালীর বঙ্গবন্ধু

১৯২০ সালের ১৭ই র্মাচ বর্তমান ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহাকুমার টুঙ্গীপড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক সপ্ন শিশু। নবজাতক শিশুর আগমনে গোটা বাড়িতে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। পরপর দুই কন্যা সন্তানের পর এই পুত্রের আগমনে বাবা আর মায়ের খুশির সীমা রইলো না। অদূরেই একই পাড়ায় ছিল শিশুটির নানা বাড়ি। দুই বাড়িতেই আত্মীয় স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশিদের মিষ্টিমুখ করানোর যেন উৎসব শুরু হলো। কথিত ছিলো, গোপালঞ্জের টুঙ্গীপড়ার প্রসিদ্ধ শেখ পরিবারে পুত্র সন্তান বেশি জন্মাতো না। এই পুত্র সন্তনের আগমনকে সবাই শুভ উপলক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে লাগলো। নানা শেখ আবদুল মজিদ পিতার সাথে মিল রেখে সদ্যজাত দৌহিত্রের নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। “মুজিব’’ শব্দের অর্থ উত্তরদাতা। পরবর্তীতে টুঙ্গীপড়ার এই মুজিব, বাবা মায়ের আদরের খোকা জগৎবিখ্যাত “শেখ মুজিবুর রহমান” নামে যিনি নিপিড়ীত, দিশেহারা, অত্যাচারিত বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন পরাক্রমশালী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” মহান স্বাধিনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন আমাদের কান্ডারী। তিনিই আমাদের জাতীর জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙগালী। যায় জন্ম না হলে আমরা পেতাম না আমাদের এই লাল সবুজের পতাকা।

টুঙ্গীপড়ার আলোবাতাসে বাবা মায়ের আদরের খোকা একটু করে বড় হয়ে ওঠেন। সমবয়সী ও প্রতিবেশিদের কাছে পরিচিত ছিলেন “মিয়া ভাই” নামে। ছোটবেলা থেকেই খোকা ছিলেন দারুন ডানপিটে স্বভাবের। কোথাও অন্যায় অত্যাচার দেখলে রুখে দাড়াতেন। অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি ছিলো তার অসীম মমতা, নেতৃত্ব দেয়ার সহজাত প্রবৃত্তি ছিলো তাঁর মাঝে। স্কুলে থাকাকালীন তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মুষ্টি ভিক্ষা সমিতি গঠন করেন। স্কুল ছুটির দিন তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করতেন। সেই চাল কখনও বিলি করতেন দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে, আবার কখনও বাজারে বিক্রি করে ছাত্রদের বই, খাতা, পেন্সিল কিনে দিতেন। যারা বাড়ি বাড়ি জায়গীর থেকে পড়াশোনা করতো তাদেরও সাহায্য করতেন। শৈশব-কৈশোরে তাঁর বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়। গোপালগঞ্জের ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেছিলেন মুসলীম ছাত্রলীগের শাখা। তখন কংগ্রেসের বেশ দাপট ছিলো। তাঁদের জনসভা, আন্দোলনে খোকা স্বতস্ফূর্ত হয়ে অংশ নিতেন। মুসলিম লীগের নেতারা আসলে, তাদের সভা, আন্দোলনেও খোকা ছিলেন অগ্রবর্তী।

কৈশোরে তৎকালীন বিখ্যাত বাঙ্গালী নেতা “নেতাজী” সুভাষচন্দ্র বোসের বক্তৃতা আন্দোলিত করত খোকাকে। এরই মধ্যে একদিন কোলকাতা থেকে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসলেন। গোপালগঞ্জের সব দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় সংবর্ধনা কমিটি। খোকা সেই সংবর্ধনা কমিটির সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।বেশ বড় সভা হয়। সেখানে ফজলুল হক সাহেব এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেব বক্তৃতা করেন। এরপর তাঁরা খোকাদের স্কুলে পরিদর্শনে যান। হঠাৎ খোকা তাঁদের সামনে গিয়ে দাড়ান। বিনয়ের সাথে বলেন যে ছাত্রদের একটা আবেদন আছে, সোহরাওয়ার্দী হেসে তাদের আবেদন শুনতে চান। উত্তরে খোকা নেতাদের জানান যে স্কুলের কয়েকটা শ্রেনীকক্ষের ছাদ ফুটো। বর্ষায় ছাদ থেকে পানি পড়ে। তিনি তাঁদের কাছে মেরামতের আর্জি জানান। খোকার কথা বলার দৃঢ়চেতা ভঙ্গি ও সাহস দেখে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুদ্ধ হন। খোকার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁরা শ্রেনীকক্ষ মেরামতের নির্দেশ দেন। খোকাকে কাছে ডেকে আদর করেন। ঠিকানা দিয়ে দিলেন। চিঠি লিখতে বললেন, কোলকাতা গেলে দেখা করতে বললেন। সেদিনের সেই কিশোর মুজিবের মধ্যে তাঁরা অমীত সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে কোনও সাধারন ছেলে নয়, এই ছেলে একদিন অনেক নাম করবে। একদিন এই অসহায় শোষণ ও অত্যাচারে নিষ্পেষিত বাঙ্গালী জাতীর স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হবে। তাঁদের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে খোকার মাধ্যমেই। পরবর্তীতে খোকা সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্যরুপে আবির্ভূত হন। অত্যন্ত ¯েœহ করতেন খোকাকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব।

অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এভাবেই ছোটবেলা থেকেই খোকার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ব্রিটিশদের থেকে নাগপাশ ছিন্ন করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এদেশের মানুষ ভেবেছিলেন যে বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা বুঝি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু অচীরেই তাদের সে ভ্রম কেটে যায়। স্বাধীনতার নামে এদেশের জনগন পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর শোষন ও বঞ্চনার স্বীকার হতে থাকে। তরুন খোকা তখন অনুধাবন করেছিলেন বাঙ্গালী জাতীর দুর্দশা। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। ক্রমাগত শোষন, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দাঁড়াতে একসময় তিনি হয়েছিলেন এদেশের মানুষের প্রধান নেতা। জনগনের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। পরবর্তীতে তাঁর নের্তৃত্বে চলে আসা স্বাধীকার আন্দোলন রুপ নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনে।


১৯৬৬ সালে খোকার ঐতিহাসিক ছয়দফা ঘোষনার পর ভিত নড়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর। আন্দোলন দূর্বার হয়ে ওঠে খোকার নেতৃত্বে। হাজার ষড়যন্ত্র, মিথ্যা মামলা তাঁকে লক্ষ্যচ্যূত করতে পারেনি। গোপালগঞ্জের খোকা এই পর্যায়ে এসে পরিচিত হন “বঙ্গবন্ধু” নামে। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে এসেছে; তাঁর আঙ্গুলী হেলনে কেঁপেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নের্তৃত্ব ও দূরদর্শী নের্তৃত্বেই ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। পরাধীন বাঙ্গালী জাতিকে তিনিই একটি মানচিত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং তাঁর নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে বহুল কাংখিত স্বাধীনতা।

সুদীর্ঘকাল হতেই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত এ বদ্বীপের জনগন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। যুগে যুগে তারা শাসিত হয়েছে বহিরাগত সেন, তুর্কি, পাঠান, মোঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানীদের। এদশের স্বাধীনচেতা মানুষরা প্রায়ই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে জীবন দিয়েছে। কখনও সফল হয়েছে , সাময়িক স্বাধীনতা অর্জন করেছে আবার পরাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকেই আমাদের চিরস্থায়ী স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তিনিই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি এদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। তাঁর ইস্পাতসম ব্যক্তিত্বের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। তিনি একজন মহান বিশ্বনেতা । মহত্মা গান্ধী, মাওসেতুং, হো-চি-মিন প্রমুখ বিশ্বনেতাদের সাথে এক কাতারে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সম্পর্কে কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা নিউজউইক তাঁকে আখ্যায়িত করে “রাজনীতির কবি” রুপে।
তিনি এদেশের মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য তিনি অসংখ্যবার কারাবরন করেন। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে চার হাজার ছয়শত বিরাশি দিন জেলে কাটিয়েছেন। তাঁর সমগ্র জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন এদেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য। তাই যতদিন এদেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে, গ্রামের মেঠো পথে রাখাল তার গরুর পাল নিয়ে যেতে যেতে গান গাইতে থাকবে, উদাস দুপুরে গলাছেড়ে ভাটিয়ালী গাইতে থাকা মাঝি নৌকা বাইতে থাকবে, ততদিন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের খোকা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সদা অক্ষয় হয়ে থাকবে। তিনি থাকবেন এদেশের প্রতিটি ধূলিকণায়, এদেশের আকাশে-বাতাসে। বাঙ্গালীর চেতনায়, মননে তিনি সদা জাগ্রত থাকবেন।

তাইতো খ্যাতিমান কবি ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন-

“যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান;
দিকে দিকে আজ অশ্রূ গঙ্গা, রক্ত গঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান”

তথ্যসূত্রঃ
১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলেবেলা – আ.শ.ম বাবর আলী
২। শেখ মুজিুবের ছেলেবেলা – বেবী মওদুদ

Author

Md. Khalid Mahbub Khan, Lecturer, Dept. of CSE, UITS
      Ms. Sultana Rokeya Nahar, Lecturer, Dept. of CSE, UITS
 Ms. Sonia Afroz, Lecturer, Dept. of CSE, UITS

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments