বঙ্গবন্ধু- বাংলাররাজনৈতিক সেতুবন্ধন

বাংলাদেশে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় ও বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে।আর্য, পাল(বৌদ্ধ),সেন(হিন্দু) রাজ বংশের শাষনের পর দশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে যা মুঘল সাম্রাজ্যের সময়কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এরপর একে একে  বহু ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে এই বাংলায়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে যা ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে  কোম্পানির হাত থেকে বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে।

স্বাধীনতার স্বাদ না পাওয়া এই জাতি নানা ধর্মের, নানা বর্ণের দ্বারা শাসিত এবং শোষিত এই বাঙ্গালী জাতী ভারতীয় বঙ্গবন্ধু- বাংলাররাজনৈতিক সেতুবন্ধনউপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ধর্ম গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পুনর্বার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশভুক্ত হয়; অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশভুক্ত হয়। যা বাংলী জাতির জন্য এক কালো অধ্যায়ের সুচনা করে। ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলী জাতি বার বার  প্রমান করার চেষ্টা করেছে তারা অন্যদের থেকে কোন অংশে কম না এবং তারা আর  কারো গোলামী করতে চায় না। আর মুক্তিযোদ্ধের মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে নতুন এক জাতি হিসাবে তুলে ধরেছে।

এই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি মোড়ে যার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে তিনি হলেন, আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০, ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাতিরজনকের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবনের সূচনা হয়।

আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমান

আবুল কাশেম ফজলুল হক যিনি শেরেবাংলা (বাংলার বাঘ) এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কূটনীতিক। তিনি কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭ – ১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী(১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬ – ১৯৫৮) ছিলেন। 

১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারী তৎকালীন বাংলার প্রধামন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিভাবে নানা বাধা বিপত্তির মধ্যেও অন্যেয়ের বিরোধে প্রতিবাদ করতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে হয় তা তিনি প্রমান করেছেন ছাত্র অবস্থায়। তার নেতৃতেই স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবী পূরণ হয়। সেই দিন থেকেই মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল। এর এক বছর পর ১৯৩৯ সালে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা করার দু:সাহসের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথম কারাবরণ করেন।

হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর  এবং শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৪২ সনে এনট্র্যান্স পাশ করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। এ সময়  তার আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার করা। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন।পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। শুরু থেকেই তিনি সক্রিয় ছাত্র নেতা হিসাবে সবার সামনে থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে যোগ দেয়। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের বাংলার জন্য রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিল। এই নির্বাচনে  শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। শুধু তাই নয়  তাকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। যদিও এই সরকার বেশি দিন স্থায়ী হয় নাই।

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বৈঠকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিব তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মহাসচিব নির্বাচিত হয়। এর দু বছর পরই ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন। শেখ মুজিব এই দাবীকে আমাদের বাঁচার দাবী শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এই ছয় দফাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র ।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে:

” একটাসময়ছিলযখনএইমাটিআরমানচিত্রথেকে “বাংলা” শব্দটিমুছেফেলারসবধরণেরপ্রচেষ্টাচালানোহয়েছিল। “বাংলা” শব্দটিরঅস্তিত্বশুধুবঙ্গোপসাগরছাড়াআরকোথাওখুঁজেপাওয়াযেতনা।আমিপাকিস্তানেরপক্ষথেকেআজঘোষণাকরছিযে, এখনথেকেএইদেশকে ‘পূর্বপাকিস্তানের‘ বদলে ‘বাংলাদেশ‘ ডাকাহবে। “

মুজিবের এই ঘোষণার ফলে সারা দেশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং এবং শেখ মুজিবুর রহমান

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬) ছিলেন বিংশশতকী ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরি হলে তার সভাপতিত্বে অণুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি যার ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারির কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান।এই সম্মেলনে  তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাকুমুসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি‘ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করে পাকিস্তান বিভক্তিকরণের ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করে,যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো শেখ মুজিবের আসন্ন প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের বিরোধিতা করে। এসময় পর্যন্ত শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগ কেউই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাধীনতার চিন্তা করেননি। একইসময়ে, পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো আসন্ন সরকার গঠনকে বানচাল করার জন্য প্রেসিডেন্ট  ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ দিতে থাকেন।

ভাসানী ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অণুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ:

“এটাইহয়তআমারশেষবার্তা, আজথেকেবাংলাদেশস্বাধীন।আমিবাংলাদেশেরমানুষকেআহ্বানজানাই, আপনারাযেখানেইথাকুন, আপনাদেরসর্বস্বদিয়েদখলদারসেনাবাহিনীরবিরুদ্ধেশেষপর্যন্তপ্রতিরোধচালিয়েযান।বাংলাদেশেরমাটিথেকেসর্বশেষপাকিস্তানিসৈন্যটিকেউৎখাতকরাএবংচূড়ান্তবিজয়অর্জনেরআগপর্যন্তআপনাদেরযুদ্ধঅব্যাহতথাকুক।”

মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। অন্যদিকে এপিলের মাঝা–মাঝি ভাসানী নদী পথে ভারতে যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এছাড়া মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুংচৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অণুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অণুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।

যুদ্ধ চলাকালোন সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।প্রায় নয় মাস ব্যাপী যুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সরাসরি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ দলের কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি দেন। লণ্ডন দিল্লি হয়ে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সেই দিন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল। মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে পিতাতুল্য মনে করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্টপ্রতি হওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মওলানা ভাসানী ছিলেন পিতার মতো। বঙ্গবন্ধুকেও তিনি পুত্রসম স্নেহ করতেন। উল্লেখ্য মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালেই বঙ্গবন্ধু তার সাধারণ সম্পাদক হয়ে ছিলেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি একজন রাজনৈতিক গুরু হিসেবে যতটা মানতেন ঠিক ততটাই তাকে একজন ধর্মীয় পথ-নির্দেশক হিসেবে মান্য করতেন।

বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায়ই কোনো নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই শুধুমাত্র গাড়ির ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মওলানার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। সে খবর তৎকালীন আওয়ামীলীগের অনেক নেতাই জানতেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। তখন মওলানা ভাসানী খুবই কেঁদেছেন। তিনি ওইদিন বার বার বলেছেন ‘সব শেষ হয়ে গেল’।

মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান

মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী নামে অধিক পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ওসমানী ১৯৩৯ সালে তিনি রয়্যাল আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।  ১৯৪২ সালে ওসমানী ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ওসমানী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে লং কোর্স পরীক্ষা দিয়ে উচ্চস্থান লাভ করেন৷  ১৯৫৬ সালে তিনি কর্নেল পদমর্যাদা লাভ করেন এবং সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের জেনারেল স্টাফ এন্ড মিলিটারি অপারেশনের ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পান। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন৷ ১৯৬৬ সালের মে মাসে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরকালীন ছুটি নেন এবং পরের বছর (১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ‘৭০-এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন৷ ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন৷

যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু এ সময় পালিয়ে যাওয়া  শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ অফিসার দায়িত্ব পালন করেন।

১২ এপ্রিল থেকে এম. এ. জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন এবং বিচক্ষণতার সাথে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায় অনেক বেশি৷ এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা৷ এজন্য এম. এ. জি. ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন৷ মে মাসের পর তার মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা গেলেও ধ্বংস করা সম্ভব নয়৷ এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন আনেন৷ প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন।

পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। এর কারন ছিল মিত্র বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া, যা তিনি পছন্দ করেননি। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সৈন্যবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী। এরা দুজনেই ছিলেন আঞ্চলিক প্রধান। অন্যদিকে ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। ওসমানী বিষয়টিকে নীতিবাচক হিসেবে দেখেন। ওসমানী এর সাথে  আরো যোগ   করেন “সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়”।

১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদা (অক্রিয়) প্রদান করা হয় এবং তিনি নব দেশের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান।

শুধু আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার একক কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি তার এ দায়িত্ব থেকে অবসর নেন, মন্ত্রীসভায় যোগ দেন অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ঐ নির্বাচনে ওসমানী তার নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন৷ ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন৷ ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে তিনি সংসদ সদস্যপদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। সেবছর ২৯শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান, তবে ৩রা নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী ‘জাতীয় জনতা পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এবং শেখ মুজিবুর রহমান

সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম পুরুষ, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের অস্হায়ী বাংলাদেশ সরকার নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে ।

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা)সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নে বীরদামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. (অনার্স), ১৯৪৭ সালে এম.এ এবং ১৯৫৩ সালে এল.এল.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৭ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ৷ তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ৷ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সু-সাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ৷ ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন ৷ ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামীলীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ৷

তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক এবং তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও অস্থায়ী সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটা সরকারের কাঠামো তৈরি করেন এবং ১০ এপ্রিল রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন৷

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ৷১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে ৷ নির্বাচনের পর পরবর্তী মন্ত্রীসভায় ও তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ৷ জাতীয় সংসদে তিনি উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৷ পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২য় বারের মত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার শোকবহ সময়ে তিনি উপ- রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও হত্যাকারীদের জন্য রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাকে প্রথমে গৃহবন্দী এবং ২৩শে আগস্ট, ১৯৭৫ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয় ৷ কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

তোফায়েল আহমেদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান

তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। ১৯৬৬৬৭ মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) নির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯-এ গণজাগরণ ও ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন তিনি ডাকসুর ভিপি হিসেবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

 আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার  বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি ৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগার দফা দাবী পেশ করে যার মধ্যে শেখ মুজিবের ছয় দফার সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এর সাথে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬,২০০৮ ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৮ পর্যন্ত।

(সংবাদপত্র ও ইন্টারনেটে থেকে সংগ্রহিত তথ্য উপাত্তর ভিত্তিতে সংকলিত। )

Author

আল-ইমতিয়াজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

0 Comments